পতনশীল বাজারে ভীতি নয়, চাই কৌশলী বিনিয়োগ
শেয়ার বাজার উত্থান-পতনের বাজার, এটা আমরা
সকলেই জানি। অবশ্য এই চিরন্তন সত্যকে আমরা কেউই সহজে মেনে নিতে চাই না। আমাদের দেশে
সকল স্তরের বিনিয়োগকারী মাত্রই প্রত্যাশা করেন মার্কেট যেন শুধু উর্ধপানে ছুটতে থাকে। যা নিতান্তই অজ্ঞতা প্রসূত অবুঝ
প্রত্যাশা। দুনিয়ার কোন বাজারই যেমন একটানা বাড়েনা ঠিক তেমনি কোন বাজারই টানা নিম্নমুখী
থাকে না। শেয়ার বাজারে ছোট বড় উত্থান-পতন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, যা চক্রাকারে চলতে থাকে।
উত্থান শেষে পতন যেমন অবশ্যম্ভাবী ঠিক তেমনি পতন শেষেও উত্থান অবশ্যম্ভাবী। সফল বিনিয়োগকারী
তাঁরাই যারা এই উত্থান পতনের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেন।
অনেকেই বলেন যে,ইউরোপ-আমেরিকার মত সভ্য
দেশের শেয়ার বাজারে প্রচলিত বিনিয়োগ কৌশল আমাদের বাজারে অচল। এখানে গেম্বলিং ছাড়া কিছুই
হয় না। যারা এমন ভাবের তাঁরা একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন। বিগত ১০০ বছরে আমেরিকান ষ্টক মার্কেটে
ত্রিশ বার মাঝারী থেকে বড় মাপের পতন ঘটেছে। গড়ে প্রতি দশ বছরে এক বার মার্কেট ক্রেশ
করেছে। এই বছরের আগস্ট মাসেই চীনা মার্কেটে ব্যাপক পতন ঘটে যা থেকে রেহাই পায়নি ইউরোপ
আমেরিকার মার্কেটগুলও। ২৪ শে আগস্ট ২০১৫, আমেরিকার মার্কেট প্রথম ৬ মিনিটেই ১,০৮৯ পয়েন্ট
পড়ে যায় যা দিন শেষে কিছুটা ভদ্র চেহারা পায়, এক দিনেই মার্কেট হারায় ৫৮৮ পয়েন্ট। এক
আগস্ট মাসেই ডাওজোন্স ১৩% পড়ে যায়।
বিনিয়োগ গুরু ওয়ারেন বাফেট এর নাম শোনেনি
এমন বিনিয়োগকারী হাল জামানায় খুঁজে পাওয়ায় ভার। বাস্তবে সম্ভব না হলেও অবচেতন মনে ওয়ারেন
বাফেট হবার স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশের হাজার হাজার
বিনিয়োগকারী। আগস্টের ঐ সপ্তাহে ওয়ারেন
বাফেট হারিয়েছেন ৩.৬ বিলিয়ন ডলার, যা তাঁর মোট বিনিয়োগের ৫% । গত এক বছর
ধরে চলা তেলের
মূল্য পতনও বাফেটের বার্কশায়ার হেতওকে ভালই ভুগিয়েছে। ২০১১-১২ সালে যখন
তেলেন দাম সর্বচ্চ উঠে যায়, তখন বাফেট বিনিয়োগ করেন তেল উৎপাদনে ব্যবহৃত
যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী দুই কোম্পানিতে।
২০১৩ ভাল কাটলেও ২০১৪ এর শুরু থেকেই তেলের দাম পড়তে থাকে, সাথে ঐ দুই
কোম্পানির শেয়ার মূল্যও। পুরো ২০১৪ সাল অপেক্ষা করেও অবস্থার কোন উন্নতি
হয়নি। অবশেষে ২০১৫ এর মাঝামাঝি ৭০ ডলারে কেনা ন্যাশনাল অয়েলহোয়েল
৪১ ডলারে আর ৮০ ডলারে কেনা ফিলিপ্স৬৬ বিক্রি করেছেন ৪৬ ডলারে। তাই বিনিয়োগ
গুরু
ওয়ারেন বাফেট বা তাঁর মত ভাল বিনিয়োগকারীগন লস করেননা এমন চিন্তা নিতান্তই
অমূলক। তারাও লস করেন, তবে তা তাদের লাভের তুলনায় নেহায়েতই ছোট। সফল
বিনিয়োগকারী তাঁরাই যারা তাদের ভুল বিনিয়োগ দ্রুত শুধরে নিতে পারেন,
লোকসানকে কেটে ছোট আর লাভকে টেনে লম্বা করতে পারেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে
বিনিয়োগ শুরু
করা ওয়ারেন বাফেট তাঁর মোট সম্পদের দুই-তৃতীয়াংশই অর্জন করেছেন ৫০ বছর
বয়সের পর। তাঁর
বিনিয়োগ সাফল্যের মূলে ছিল ভাল কোম্পানি বাছাই করার দক্ষতা আর ঐ সব
কোম্পানিতে ধীর্ঘ
সময় ধরে বিনিয়োগ করার মানসিকতা। বাজারে শেয়ার মূল্যের যাই খারাপ অবস্থা
থাকুক কোম্পানির ব্যবসায়িক অবস্থা খারাপ
না হলে তিনি শেয়ার হাত ছাড়া করতেন না।
পতনশীল বাজারে সবাই যখন বিক্রি করে বাজার
থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে যেত, বাফেট তখন নিশ্চিন্তে শেয়ার কিনতেন। কারণ কম দামে ভাল
শেয়ার কিনতে পারার এই দূর্লভ সুযোগ পাওয়ায়া যায় শুধু মাত্র পড়তি বাজারে। বাফেট তাই পড়তি
বাজারে ভীত না হয়ে বরং উৎফুল্ল হতেন। কারণ নিম্নমুখী বাজার তাকে সস্তায় ভাল ভাল কোম্পানির
শেয়ার কেনার সুযোগ করে দিত। ভাল শেয়ার কম দামে কিনে ধৈর্য ধারণ করে অপেক্ষা করাই ছিল
তাঁর বিনিয়োগের মূলনীতি। মন্দা কাটিয়ে বাজারে তেজী ভাব এলেই তিনি বিক্রি শুরু করতেন।
সবাই যখন ক্রেতা বাফেট তখন বিক্রেতা। আর সবাই যখন বিক্রেতা বাফেট তখন ক্রেতা। এই অতিসাধারণ
বিনিয়োগ চিন্তাই পুঁজিবাজারের কিংবদন্তী ওয়ারেন বাফেটের বিজনেস সিক্রেট।
পাঠকদের অনেকেই মনে মনে বিরক্ত হয়ে ভাবছেন,
এই সরল বিনিয়োগ চিন্তায় সাফল্য অর্জন শুধু আমেরিকার মত সভ্য দেশেই সম্ভব। বাংলাদেশের
মত তৃতীয় বিশ্বের দুর্নীতিগ্রস্থ দেশে এগুল কোন কাজেই আসে না। কিন্তু সত্যি হল এই অতিসাধারণ
নিয়ম বাংলাদেশেও ভালই কাজ করে। নিজের সাম্প্রতিক কিছু অভিজ্ঞতা তাই উদাহরণ হিসেবে শেয়ার
করি। মার্চ থেকে মে ২০১৫, এই তিন মাসেই ঢাকা ষ্টক এক্সচেঞ্জের সূচক ৪৮০০ থেকে টানা পতনে ৪০০০
এ নেমে আসে। অথচ মে-জুন মাসেই ডিসেম্বর ক্লোজিং কোম্পানিগুল ডিভিডেন্ড দেয়া শুরু করবে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতের ভাল ভাল কোম্পানিগুল ৭-৮ পিই রেশিওতে লেনদেন হচ্ছিল। সবাই
যখন আরেকটি পতনের ভয়ে ভীত হয়ে গণহারে শেয়ার বিক্রি করছে; আমি অখন কিছুটা সাহস সঞ্চয়
করে কেনা শুরু করলাম। আমার পক্ষে যতটা সম্ভব ততটাই কিনে অপেক্ষায় রইলাম। চিন্তা ছিল
যদি বেশি দামে বেচে প্রফিট গেইন সম্ভব না হয় তবে বোনাসগুলি নিয়ে নিব। ব্যাংকগুল যেখানে
এক বছরে ১০০ টাকায় মাত্র ৮-৯ টাকা সুদ দেয়, সেখানে ২৫-৩০% হারে ডিভিডেন্ড দেয়া কোম্পানিগুল
অনায়াসে ১২-১৫% মুনাফা দিবে। আর আল্লাহর অসীম রহমতে ঘটেছেও তাই। জুন-জুলাই মাসেই ইনডেক্স
৭০০ পয়েন্ট রিকভার করে আবার ৪৭০০ এর ঘরে চলে আসে। আর তিন মাসেই আমি চারটি কোম্পানি
থেকে গড়ে ১৮% হারে মুনাফা করতে সক্ষম হই।
বর্তমান সময়ের পড়তি বাজার আবারো কিছু সুযোগ
তৈরি করেছে। গত এক মাসের সূচক পতনে খারাপ ভাল সব শ্রেণীর শেয়ারের দামই অনেকটা কমেছে। অথচ জুন
ক্লোজিং কোম্পানিগুলোর ডিভিডেন্ড দরোজায় কড়া নাড়ছে। এই সময়ে ভীত না হয়ে যারা কৌশলী
হয়ে কম দামে ভাল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই অন্যদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে
গিয়েছেন। আজ হোক বা কাল, পতন শেষে বাজার এক সময় আবার ঘুরে দাঁড়াবে। তখন এই পড়তি বাজারের
ক্রেতারা চড়া লাভে বিক্রি করার সুযোগ পাবেন। আর যারা এখন ভীত হয়ে ভাল শেয়ার হাত ছাড়া
করছেন, তাঁরাই হুমড়ি খেয়ে ক্রেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।উঠতি বাজারের ঐ ক্রেতাদের মধ্যে অল্প
সংখ্যক লাভের মুখ দেখবেন আর বাকিরা হতাশ হবেন। কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই পড়তি বাজারে বিনিয়োগ
করা কৌশলী বিনিয়োগকারীগন বড় অংকের মুনাফা করবেন।
Courtesy By: Hasan Shaharear
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.